Tuesday, March 12, 2013

কাপ্তাইঃ সবুজের মাঝে হারিয়ে যাবো আবারো


কাপ্তাই উপজেলার আয়তন ২৫৯ বর্গ কিমি। চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙামাটি পার্বত্য জেলার অন্তর্গত কাপ্তাই উপজেলার ভৌগোলিক অবস্থান ২২°২১' হতে ২২°৩৫' উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯২°' হতে ৯২°১৮' পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। উপজেলার উত্তরে কাউখালী ও রাঙামাটি, পূর্বে বিলাইছড়ি  রাজস্থলী উপজেলা, পশ্চিমে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও দক্ষিণে রাজস্থলী উপজেলা।



কাপ্তাই উপজেলার নামকরণে 'কত্থয়' 'কিয়ং' শব্দ দু'টির প্রভাব রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। কত্থয় অর্থ কোমর আর কিয়ং অর্থ খাল। ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে 'পার্বত্য চট্টগ্রাম'-কে চট্টগ্রাম জেলা থেকে আলাদা করে নতুন জেলা সৃষ্টি করার পর কাপ্তাই এর চন্দ্রঘোনায় এর সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। কাপ্তাই থানা সৃষ্টি হয় ১৯৭৬ সালে এবং থানাকে উপজেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৫ সালে। কাপ্তাইকে উপজেলায় রূপান্তরের পূর্ব পর্যন্ত এটি রাঙামাটি পার্বত্য জেলার একটি মহকুমা ছিল। এ উপজেলায় বাঙালিসহ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং, খিয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া জাতিসত্বার বসবাস রয়েছে।



কি কি দেখবেন কাপ্তাইয়ে?

·        কাপ্তাই হ্রদ-কাপ্তাই হ্রদ বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের রাঙামাটি জেলার একটি কৃত্রিম হ্রদ। কর্ণফুলি পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৯৫৬ সালে কর্ণফুলি নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ করা হলে রাঙামাটি জেলার ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি ডুবে যায় এবং এ হ্রদের সৃষ্টি হয়।


·        কর্ণফুলী পেপার মিল
·        কাপ্তাই বাঁধ-পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। ১৯৬২ সালে এর নির্মাণ শেষ হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউতাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেট ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ ও ৫৪.৭ মিটার উচ্চতার এ বাঁধটি নির্মাণ করে। এ বাঁধের পাশে ১৬টি জলকপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা স্প্রিলওয়ে রাখা হয়েছে। এ স্প্রিলওয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক ফিট পানি নির্গমন করতে পারে। এ প্রকল্পের জন্য তখন প্রায় ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা বাজেট নির্ধারণ করা হলেও পরে তা ৪৮ কোটি ছাড়িয়ে যায়। কাপ্তাই হ্রদে পানি সংরক্ষণ করে প্রতিদিন প্রায় ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।



·        নেভীক্যাম্প পিকনিক স্পট



·        জুম রেস্তোরা পিকনিক স্পট











·        ওয়াগ্গা টি এস্টেস : ১৮৮৬ সালে ব্রিটিশ নাগরিক মি: ডরিন এর নেতৃত্বে কর্ণফুলী নদীর উভয় তীরে ওয়াগ্গাছড়া এলাকায় চা বাগান সৃজনের কাজ শুরু হয়। প্রায় ৫০ বছর সময়কাল চা বাগানের কর্তৃত্ব ব্রিটিশদের হাতে থাকার পর এটির হাত বদলের ধারাবাহিকতায় চা বাগানের মালিকানা লাভ করেন নুরুল হুদা কাদেরী। বর্তমানে কাদেরী পরিবারের ব্যবস্থাপনায় ওয়াগ্গাছড়া টি লিমিটেডনাম দিয়ে চা শিল্পের পরিচালনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ টি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নতুন উদ্ভাবিত প্রায় সব কয়টি জাতই এ চা বাগানে চাষ করা হচ্ছে।৩৭০ হেক্টর আয়তনের এ বাগানে বাগান কর্তৃপক্ষের নিজস্ব একটি ফ্যাক্টরীও রয়েছে।
·        চিৎমরম বৌদ্ধ মন্দির
·        কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান- তের হাজার একর এলাকা নিয়ে কর্ণফুলী নদীর কোল ঘেঁষে কাপ্তাই উপজেলায় গড়ে উঠেছে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান। সারি সারি পাহাড় আর প্রকৃতির অপর্ব সমন্বয় ঘটেছে এখানে। উপমহাদেশের যে কটি প্রাচীন উদ্যান আছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম এটি। রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাই উপজেলায় এটি গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৫৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এ বনের অবস্থান। আর রাঙ্গামাটি শহর থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার।  ১৮৭৩, ১৮৭৮ এবং ১৮৭৯ সালে এখানে বনায়নের ফলেই গড়ে উঠেছিল একটি ক্রান্তীয় বনাঞ্চল। ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনের আওতায় ১৯৯৯ সালে এটি জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা পায়। এর আগে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান সীতাপাহাড় সংরক্ষিত বনের অংশ ছিল।

পাহাড়ের ঢালে ঢালে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবর্ণনীয়। নানা রকম গাছপালা সমৃদ্ধ এ উদ্যানে আছে-- সেগুন, চাপালিশ, জারুল, চম্পা, সোনালু, চালতা, চিকরাশি, শাল, শিলকড়ই, ধারমারা, গামারি, অর্জুন, আমলকি, আমড়া, বহেরা, বাজনা, বড়ই, পিটরাজ, পিটাল, বাঁশপাতা, বৈলাম, নাগেশ্বর, হিজল, উদল, উরিয়া, লোহাকাঠ ইত্যাদি। এসব গাছপালার ছায়ার নিচ দিয়ে আঁকাবাঁকা পায়েচলা পথে হাঁটলে মন হারিয়ে যাবে অজানায়।
নানান জীববৈচিত্র্যেও সমৃদ্ধ এ বনাঞ্চল। কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের বাসিন্দাদের মধ্যে আছে বন্যহাতি, হরিণ, হনুমান, উল্লুক, শুকর, বনবিড়াল, গুইশাপ, অজগর ইত্যাদি। ভাগ্য ভালো থাকলে বিশ্বের অন্যতম বড় বিষধর সাপ শঙ্খচুরের দেখা পেয়ে যেতে পারেন। বর্তমানে প্রায়ই এ বনে বন্যহাতির দেখা মিলছে। দলবেঁধে হাতিরা বনের ভেতরে ঘুরে বেড়ায় অবাধে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখপাখালির নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র এই জঙ্গল। ধনেশ, ফিঙ্গে, বুলবুলি, কাঠময়ূর, বনমোরগ, ময়না, ঘুঘু, টিয়া, মাছারাঙ্গাসহ নানান ধরনের পাখির দেখা মিলবে গাছের ডালে, ঝোপের আড়ালে। তবে তাদের দেখতে চাইলে ঠোঁটে কুলুপ এঁটে চলতে হবে বনের পথে।

বন এলাকা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির আওতায় বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণস্থান আর পায়েহাঁটা পথ তৈরি করা হয়েছে এ বনে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উল্লেখযোগ্য পথটি হল ব্যাঙছড়ির মাঝারি বনপথ। চট্টগ্রাম-কাপ্তাই মহাসড়কের ব্যাঙছড়ি মারমাপাড়া থেকে শুরু হওয়া বনের ভেতর পথটির দৈর্ঘ্য আড়াই কিলোমিটারের একটু কম। এ পথেই জীববৈচিত্র্য সবচেয়ে বেশি। রয়েছে বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র এবং টাওয়ার। উঁচুনিচু পাহাড়ি এ পথে আরও আছে ছোটবড় কয়েকটি ঝরনা।
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান এলাকায় আছে মারমা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের দুটি গ্রাম। একটি ব্যাঙছড়ি মারমাপাড়া অন্যটি চিৎমুরং বড়পাড়া। এসব গ্রামে দেখতে পাবেন তাদের বৈচিত্র্যময় জীবনধারা। তবে গ্রামে প্রবেশের আগে অবশ্যই কারবারি বা হেডম্যানের অনুমতি নিয়ে নিতে হয়।

যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন কিংবা আকাশপথে চট্টগ্রাম আসতে হবে। এখানে বহদ্দারহাট বাস স্টেশন থেকে পনের মিনিট পরপর বাস ছেড়ে যায় কাপ্তাই এর উদ্দেশ্যে। পৌঁছাতে সময় লাগে দেড়-দুই ঘন্টা। ভাড়া ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এ ছাড়া ঢাকা থেকে সরাসরি কাপ্তাই যায় ডলফিন, সৌদিয়া, এস আলম, শ্যামলী পরিবহনের বাস। ঢাকার কলাবাগান, ফকিরাপুল ও সায়দাবাদ থেকে এসব বাস ছেড়ে যায়। ভাড়া ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা।
থাকবেন যেখানে
থাকার জন্য রয়েছে সাধারণমানের কিছু হোটেল। কাপ্তাই শহরের এসব হোটেলগুলো হল- হোটেল থ্রি স্টার, হোটেল নিরাপদ, বোয়ালখালি বোর্ডিং, কামাল বোর্ডিং ইত্যাদি। ২০০ থেকে ৬০০ টাকায় দুইজন থাকার কক্ষ আছে। এ ছাড়া বন বিভাগের রেস্ট হাউজে থাকতে হলে পূর্বানুমতির প্রয়োজন হবে। কাপ্তাই এলাকায় খাবার জন্য সাধারণ মানের বেশ কিছু রেঁস্তোরা আছে। সবচেয়ে ভালো খাবারের জন্য বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ঝুম রেঁস্তোরা উৎকৃষ্ট।
জঙ্গল ভ্রমণে করণীয়
সবসময় হালকা কাপড় পরবেন। পোশাকের রংও হবে হালকা। পায়ে পরবেন জুতা। রোদচশমা, রোদটুপি, ছাতা, পানির বোতল সঙ্গে নেবেন। বর্ষায় ভ্রমণে গেলে অবশ্যই ছাতা বা রেইনকোট সঙ্গে নিন। পোকামাকড় আর মশার হাত থেকে বাঁচতে পতঙ্গনাশক ক্রিম নিতে ভুলবেন না। জঙ্গলে বর্ষায় জোঁকের উপদ্রব বাড়ে। তাই জোঁক থেকে বাঁচতে মোজার মধ্যে প্যান্ট গুঁজে নিন। দূরের বন্যপ্রাণী আর পাখি দেখতে দুরবিন নিতে পারেন। জঙ্গলে ভ্রমণের সময় যথাসম্ভব চুপচাপ থাকার চেষ্টা করুন। বেশি আওয়াজে বন্যপ্রাণীরা বিরক্ত হয়। তখন তাদের দেখা পাওয়া কঠিন হবে। প্লাস্টিক জাতীয় প্যাকেট, বোতল, ক্যান সঙ্গে আনলে সেগুলো বনে ফেলে পরিবেশ নষ্ট করবেন না। সঙ্গে করে বাইরে এনে ময়লা ফেলার জায়গায় ফেলুন।  
জঙ্গলে যা করবেন না
পিকনিক করতে জঙ্গলে যাবেন না। ভ্রমণে উচ্চশব্দে বা মাইকে গান কিংবা কোনোকিছু বাজাবেন না। বন্যপ্রাণীরা বিরক্ত হয় এমন কোনো শব্দ কিংবা আওয়াজ করবেন না। ময়লা, প্লাস্টিক জাতীয় কোন কিছু জঙ্গলে ফেলবেন না। বনে ধূমপান করবেন না। 
প্রয়োজনীয় তথ্য
কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে একাকী ভ্রমণ না করাই ভালো। দলবদ্ধভাবে ভ্রমণে গেলে অবশ্যই অভিজ্ঞ গাইড সঙ্গে নেওয়া উচিৎ। তাতে জঙ্গলে ভ্রমণ এবং বন্যপ্রাণী দেখা সহজ হবে। কাপ্তাই উদ্যানে প্রশিক্ষিত কয়েকজন গাইড আছেন। নির্ধারিত সম্মানির বিনিময়ে এসব গাইডের সেবা নেওয়া যাবে। কয়েকজন গাইডের মোবাইল নম্বর- করিম উদ্দীন ০১৮২২২৭৩১৮০, নান্টু চাকমা ০১৮৩১৫৪৬০৪২, মং চিং ই মারমা ০১৮২২১৫৩৫৩৭, বিপ্লব বড়ুয়া ০১৮১২০৭৫৪৪৫।
এছাড়া যে কোনো প্রয়োজনে যোগাযোগ করতে পারেন কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের কার্যালয়ে ০৩৫২৯-৫৬৩৫৭।

No comments:

Post a Comment